যাকাত কি ? যাকাত কাদের উপরে ফরজ এবং কাদেরকে দিতে হবে ?

 যাকাতের গুরুত্ব ও ফজিলতঃ-   

যাকাত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। ঈমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অপরিহার্য ইবাদত হল নামাজ এবং যাকাত। কোরআনুল কারীমের মধ্যে বহু স্থানে যাকাতের আদেশ করা হয়েছে এবং আল্লাহর আনুগত্য বান্দাদের জন্য অশেষ সওয়াব রহমত ও মাগফিরাতের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এক আয়াতে বলা হয়েছে। 

وَاَقِيْمُوا الصَّلَاةََ وَاٰتُوا الزَّكَاةَ  ؕ وَمَا تَقَدَّمُوا لِاَنْفُسِكُمْ مِنْ خَيْرٍ تَجِدُوْهُ عِنْدَ اللهِ ؕ  اِنَّ اللهَ بِمَا تَعْمَلٌُوْنَ بَصِیْرٌ۝۱۱۰ 

তোমরা সালাত আদায় কর এবং যাকাত প্রদান কর।তোমরা যে উত্তম কাজ নিজের জন্য অগ্রে প্রেরণ করবে তা আল্লাহর নিকটে পাবে। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখছেন। 
সূরা বাকারাঃ আয়াত ১১০

অন্য আয়াতে যাকাতের গুরুত্বপূর্ণ সুফল বর্ণনা করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

خُذْ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيْهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ ؕ اِنَّ صَلَاتَكَ سَكَنٌ لَّهُمْ ؕ وَاللهُ سَمِيْعٌ عَلِیْمٌ۝۱۰۳

-তাদের সম্পদ থেকে সদকাহ গ্রহণ করুন, যার দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র করবেন এবং পরিশোধিত করবেন এবং আপনি তাদের জন্য দোয়া করবেন। আপনার দোয়া তো তাদের জন্য চিত্ত স্বস্তিকর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ। সূরা তাওবাহ ১০৩ 

আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের জন্য আজিরুন আজিম এর প্রতিশ্রুতি দিয়ে এরশাদ করেন- 

  ۝۱۶۲وَالْمُقِيمِيْنَ الصَّلٰوةَ وَالْمُؤْتُوْنَ الزَّكَاةَ وَ الْمُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَ الْيَوْمِ الْاٰخِرِ ؕ اُولٰٓىِٕكَ سَنُؤْتِيْهِمْ اَجْرً عَظِيْمًا

এবং যারা সালাত আদায় করে,যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে আমি তাদেরকে মহাপুরুষ্কার দিব। সূরা নিসাঃ ১৬২

এছাড়াও কোরআন শরীফের বিভিন্ন আয়াত দ্বারা এটা স্পষ্ট যে, সালাত ও যাকাতের পাবন্দী ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য অর্জন সম্ভব নয়। কোরআন শরীফের বিভিন্ন আয়াতে যেখানে মুমিনের গুণ এবং বৈশিষ্ট্য উল্লেখ হয়েছে সেখানেই সালাত ও যাকাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। 

যারা সালাত যাকাত আদায় করে কোরআন মাজিদের মধ্যে তাদেরকে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন গুনে গুণান্বিত করা হয়েছে। যেমনঃ

মসজিদ আবাদকারীঃ মসজিদ আবাদকারীদের পরিচয় জানতে চাইলে সালাত ও যাকাত তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে। সুরাট তওবাঃ ১৮। 

মুমিনের বন্ধুঃ মুমিনদের বন্ধুরা কারা এই প্রশ্নের উত্তরেও সালাত ও যাকাতের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা মায়েদাঃ ৫৫। 

সৎকর্মপরায়ণশীলঃ সৎকর্মপরায়ণদের বৈশিষ্ট্য ও কর্মের তালিকায় সালাত ও যাকাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা লোকমানঃ ৪।

কোরআন মাজীদ হেদায়েত ও সুসংবাদদাতাঃ কোরআন মাজিদ কাদের জন্য হেদায়েত ও সুসংবাদ দাতা এর উত্তর পেতে চাইলেও সালাত ও যাকাতের কথা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সূরা নামলঃ ৩। 

দ্বীনের মৌলিক পরিচয়ঃ দ্বীনের মৌলিক পরিচয় সলাত ও যাকাত ছাড়া অসম্ভব।

সর্বশেষ কথা হল, এত অধিক গুরুত্বের সঙ্গে সালাত ও যাকাত প্রসঙ্গে কোরআন মাজীদে বর্ণনা করা হয়েছে যে, এটা ছাড়া দ্বীন ও ঈমানের অস্তিত্বই কল্পনা করা অসম্ভব। 

যাকাতের সংজ্ঞাঃ- 

ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রহমাতুল্লাহ বলেন, 

وَالزَّكَاةُ اَمْرٌ مَقْطُوْعٌ بِهِ فِي الشَّرْعِ  يُسْتَغْنَى عَنْ تَكَلُّفٍ الْاِحْتِجَاجِ لَهُ , وَاِنَّمَا وَقَعَ الْاِخْتِلَافُ فِي بَعْضِ فُرُوْعِهِ, وَأَمَّا أَصْلُ فَرْضِيَّةِ الزَّكَاةِ فَمَنْ جَحَدَهَا كَفَرَ.

যাকাত শরীয়তের এমন এক অকাট্য বিধান, যে সম্পর্কে দলিল প্রমাণের আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। যাকাত সংক্রান্ত কিছু কিছু মাসলায় ইমাম দের মধ্যে মত ভিন্নতা থাকলেও মূল বিষয়ে অর্থাৎ যাকাত ফরজ হওয়ার বিষয়ে কোনো মতভেদ নেই। যাকাতের ফরজিয়াত কে যে অস্বীকার করবে, সে কাফের হয়ে যাবে বা ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে। ফাতহুল বারী ৩/৩০৯

যাকাত তাগকারীর পরিণতিঃ-

উপরে উল্লেখিত আলোচনা থেকে যাকাতের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা এবং যাকাতের উপকারিতা সম্পর্কে জানা গেল। এখন এ বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে গেল যে যাকাত ফরজ হওয়া সত্ত্বেও যারা যাকাত আদায় করে না তারা কত বড় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। তারা যাকাতের সকল সকাল থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি আল্লাহতালার আদেশ অমান্য করার কারণে তাদেরকে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে বলেন'

وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِيْنَ يَبْخَلُوْنَ بِمَا اٰتٰاهُمُ اللّهُ مِنْ فَضْلِه هُوَ خَيْرًا لَّهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ سَيُطَوَّقُوْنَ مَا بَخِلُوْا بِه يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلِلّهِ مِيْرَاثٌ السَّمَاوَاتِ وَ   الْاَرْضِ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِيْرٍ۝

আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা তোমাদেরকে দিয়েছেন তাতে যারা কৃপণতা করে তারা যেন কিছুতেই মনে না করে যে,এটা তাদের জন্য মঙ্গল। না,এটা তাদের জন্য অমঙ্গল। যে সম্পদে তারা কৃপণতা করেছে কেয়ামতের দিন তা-ই তাদের গলায় বেড়ি হবে। আসমান ও জমিনের স্বত্বাধিকার একমাত্র আল্লাহই। তোমরা যা কর আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবগত। সূরা আল ইমরান ১৮০। 

وَالَّذِيْنَ يَكْنِزُوْنَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُوْنَهَا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ . فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ اَلِيْمٍ ۝  يَوْمَ يُحْمَى عَلَيْهَا فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوْبُهُمْ وظُهُوْرُهُمْ..هَذَا مَا كَنَزْتُمْ لِاَنْفُسِكٌمْ فَذُوْقُوْا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُوْنَ۝ 

যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পূঞ্জিভূত রাখে এবং  তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না,তুমি তাদেরকে মর্মান্তিক শাস্তির সুসংবাদ দাও। যেদিন জাহান্নামের অগ্নিতে তা উত্তপ্ত করা হবে অতপর তা দ্বারা তাদের কপালে,পার্শ্বদেশে ও পৃষ্ঠদেশে সেঁক দেয়া হবে। (আর বলা হবে) এটাই তা-ই যা তোমরা নিজেদের জন্য মজুদ করে রেখেছিলে। সুতরাং তোমরা যা মজুদ করে রেখেছিলে তার স্বাদ আস্বাদন করো। 
সুরা তওবা ৩৪-৩৫

হাদিস শরীফে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম বলেছেন- 

عَنْ اَنَسٍ بْنِ مَالِكٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَانِعُ الزَّكَاةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِي النَّارِ 

আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যাকাত ত্যাগকারী কেয়ামতের দিন জাহান্নামে প্রবেশ করবে। 

অন্য হাদিসের রাসূল সাঃ বলেছেন, 

عَنْ اَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ أَتَاهُ اللهُ مَالًا فَلَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَهُ مُثِّلَ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ شُجَاعًا اَقْرَعَ لَهُ زَبِيْبَتَانِ يُطَوَّقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ثُمَّ يَأْخُذُ بِلِهْزِمَتَيْهِ يَعْنِي شِدْقَيْهِ ثُمَّ يَقُوْلُ: أَنَا مَالُكَ, أَنَا كَنْزُكَ-

যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা ধন-সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সেই ব্যক্তি এর যাকাত আদায় করে না কেয়ামতের দিন তার সম্পদকে টেকো (বিষের তীব্রতার কারণে) মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে। সাপটি তার মুখের দুপাশে কামড়ে ধরে বলবে, আমি তোমার সম্পদ আমি তোমার জমাকৃত মাল। 
-সহীহ বুখারী ১৪০৩

এই গুরুত্বপূর্ণ ফরজ আদায়ের জন্য আবশ্যক হলো,এ বিষয়ের শরয়ী মাসলা-মাসায়েল গুলো ভালোভাবে জানা। এই উদ্দেশ্যেই যাকাতের মৌলিক ও নৃত্য প্রয়োজনীয় মাসলা-মাসায়েল গুলো ফিকহ ও হাদিসের কিতাবের ভিত্তিতে এই অধ্যায়ে উল্লেখ করার চেষ্টা করব। তবে সকল মাসালা এখানে আলোচিত করা সম্ভব নয়। 

যাকাত ফরজ হওয়ার শর্তাবলী নিম্ন রূপঃ

১. ইসলাম
২. সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হওয়া
৩. বালেগ হওয়া
৪. স্বাধীন 
৫. ঋণ থেকে মুক্ত হওয়া
৬. সম্পদের উপর পূর্ণাঙ্গ মালিকানা থাকতে হবে।
৭. সম্পদ উৎপাদনক্ষম ও বর্ধনশীল হতে হবে।
৮. মৌলিক প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ থাকা
৯. নিসাবের মালিক হওয়া ও তার স্থিতিশীল থাকা 
১০.বছর পূর্ণ হওয়া

ইসলামঃ কাফিরের উপর যাকাত ফরজ নয়। যাকাতের নামে সে প্রদান করলেও আল্লাহ তা'আলা তা কবুল করবেন না।আল্লাহ বলেন,

وَمَا مَنَعَهُمْ اَنْ تُقْبَلَ مِنْهُمْ نَفَقتُهُمْ إَلَّا اَنَّهُمْ كَفَرُوْا بِاللهِ وَبِرَسُوْلِه وَلَا يَأْتُوْنَ الصَّلَاةَ إِلَّا وَهُمْ كُسَالي وَلَا يُنْفِقُوْنَ إِلَّا وَهُمْ كَارِهُوْنَ۝

-তাদের সম্পদ দেয় শুধুমাত্র এ কারণে গ্রহণ করা হবে না যে তারা আল্লাহু ও তাঁর রাসূলের সাথে কুফরি করেছে অলস ভঙ্গিতে ছাড়া তারা ছাড়াতে আসে না এবং মনের অসন্তুষ্টি নিয়ে খরচ করে। 
সূরা তাওবা আয়াত ৫৪ 

সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারীঃ যাকাত ফরজ হতে হলে সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হতে হবে। সুতরাং পাগলের উপরে যাকাত ফরজ না। 
রদ্দবুল মুহতার ৩/৩০৭
বালেগ হওয়াঃ যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য শর্ত হলো বালে হওয়া। সুতরাং নাবালেগের উপরে যাকাত ফরজ হবেনা। 
রদ্দুল মুহতার ২/২৫৮-২৫৯ 

স্বাধীনঃ ক্রীতদাসের কোন সম্পদ নেই কোন সম্পদ থাকলেও তা তার মালিকের সম্পদ হিসেবে গণ্য হবে। সুতরাং ক্রীতদাসের যেহেতু সম্পদ নেই তাই তার ওপরে যাকাত আবশ্যক হবে না। 
বাদায়েউস সনায়ে: ২/৭৬, রদ্দুল মুহতার: ৩/২০৭-২০৮

ঋণ থেকে মুক্ত হওয়াঃ ঋণ থেকে মুক্ত হওয়ার অর্থ হলো কারো ঋণ এত পরিমাণ না হওয়া যা বাদ দিলে তার কাছে আর যাকাতের নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে না। মুয়াত্তা মালেক ১০৭, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ৭০০৩,৭০৮৬,৭০৮৯,৭০৯০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/৫৪৭-৫৪৮; আদ্দুররুল মুকখতার ২/২৬৩; বাদায়েউস সানায়ে ২/৮৩

তবে এখানে এই প্রসিদ্ধ মাসালাটি সকল ঋণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। 
ঋণ দুই প্রকার। ১. প্রয়োজনাদি পূরণের জন্য বাধ্য হয়ে যে ঋণ নেওয়া হয়। ২. ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যে ঋণ নেয়া হয়।
প্রথম প্রকারের ঋণ সম্পদ থেকে বাদ দিয়ে যাকাতের নিসাব বাকি থাকে কিনা তা হিসাব করতে হবে। যদি নিসাব বাকি থাকে,তাহলে তার ওপর যাকাত ফরজ হবে,অন্যথায় নয়। কিন্তু যে সকল ঋণ উন্নয়নের জন্য নেয়া হয় যেমন,কারখানা বানানো কিংবা ভাড়া দেওয়া বা বিক্রি করার উদ্দেশ্যে বিল্ডিং বানানো অথবা ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ঋণ নেওয়া হয়, সে সকল ঋণ যাকাতের হিসাবের সময় ঋণ হিসেবে ধর্তব্য হবে না। অর্থাৎ এ ধরনের ঋণের কারণে যাকাত কম দেওয়া যাবে না। 
মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক হাদিস ৭০৮৭।

ঋণের আরো কিছু উদাহরণঃ-

১.বিয়ে-শাদীতে মোহরানার যে অংশ বাকি থাকে তা স্বামীর কাছে স্ত্রীর পাওনা। কিন্তু এই পাওনা স্বামীর উপর যাকাত ফরজ হওয়া না হওয়ার ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলে না। সুতরাং যাকাতযোগ্য সম্পদের হিসাবের সময় এই ঋণ বাদ দেওয়া যাবে না। বরং, সমুদয় সম্পদের যাকাত দিতে হবে। 
রদ্দুল মুহতার ২/২৬১

২.অন্যকে যে টাকা কর্জ হিসেবে দেওয়া হয় বা ব্যবসায়ী কোন পণ্য বাকিতে বিক্রয় করা হয় এই পাওনা টাকা পৃথকভাবে বা অন্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে মিলিতভাবে নিসাব পূর্ণ করলে তারও যাকাত দিতে হবে। মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক হাদিস ৭১১১,৭১১৩,মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/৪৮৪-৪৮৬.

৩.পাওনা উসুল হওয়ার পর ওই টাকার যাকাত আদায় করা ফরজ হয়। তার আগে আদায় করা জরুরি নয়।তবে আদায় করলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে।মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা হাদিস ১০৩৪৭,১০৩৫৬
.
৪.উপরোক্ত ক্ষেত্রে পাওনা উসুল হতে যদি কয়েক বছর সময় অতিবাহিত হয়ে যায়।তাহলে উসুল হওয়ার পর বিগত সকল বছরের যাকাত আদায় করা ফরজ হয়। মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক হাদিস ৭১১৬ ; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা হাদিস ১০৩৪৬, ১০৩৫৬.

৫.স্বামীর কাছে পাওনা মোহরানা নিসাব পরিমাণ হলেও স্ত্রীর হস্তগত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাতে যাকাত ফরজ হবে না। হস্তগত হওয়ার পর যদি আগে থেকেই ঐ মহিলার কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদ না থাকে তাহলে এখন থেকে বছর গণনা শুরু হবে এবং বছর পূর্ণ হওয়ার পর যাকাত আদায় করতে হবে। 

৬ আর যদি স্ত্রী মোহরানা পাওয়ার আগ থেকে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক থেকে থাকে,তাহলে এই সদ্যপ্রাপ্ত মোহরানা অন্যান্য টাকা-পয়সা বা সম্পদের সাথে যোগ হবে এবং সেইসব পুরনো সম্পদের বছর পূর্ণ হওয়ার পর সমুদয় সম্পদের যাকাত দিতে হবে।

সম্পদের উপর পূর্ণাঙ্গ মালিকানা থাকাঃ সম্পদের উপর পূর্ণাঙ্গ মালিকানা থাকার অর্থ হলো এই সম্পদের মধ্যে অন্য কারো মালিকানা বা হস্তগত থাকা যাবে না। অর্থাৎ সম্পদ মালিকের অধিকারে থাকা, সম্পদের উপর অন্যের অধিকার বা মালিকানা না থাকা এবং নিজের ইচ্ছামত সম্পদ ভোগ ও ব্যবহার করার পূর্ণ অধিকার থাকা। সুতরাং এমন সম্পদের যাকাত তার উপর আবশ্যক হবে না,যা তার হস্তগত নেই বা তার অধিকারে নেই। যেমন, কোন নিসাব পরিমাণ সম্পদ যা হারায়ে গেছে বা বাদশাহ জোরপূর্বক নিয়ে নিছে। বাদায়েউস সানায়ে ২/৩৯০ 

সম্পদ উৎপাদনক্ষম ও বর্ধনশীল হওয়াঃ যাকাত আবশ্যক হওয়ার জন্য শর্ত হলো সম্পদ উৎপাদনক্ষম ও বর্ধনশীল হতে হবে অর্থাৎ সম্পদ এমন হতে হবে যার মূল্য বর্ধনশীল ও প্রবৃদ্ধিশীল। অর্থাৎ সম্পদ বৃদ্ধি পাবার যোগ্যতাই যথেষ্ট। যেমনঃগরু,মহিষ,ব্যবসায়ের মাল,নগদ অর্থ,ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে কৃত যন্ত্রপাতি,সোনা-রুপা ইত্যাদি মালামাল বর্ধনশীল। সুতরাং,যে সকল মালামাল নিজের প্রবৃদ্ধি সাধনে সক্ষম নয়,সেসবের উপর যাকাত ধার্য হবে না।যেমনঃ ব্যক্তিগত ব্যবহারের মালামাল, চলাচলের বাহন ইত্যাদি। বাদায়েউস সানায়ে ২/৩৯৪

মৌলিক প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ থাকাঃ সারা বছরে মৌলিক প্রয়োজন মিটিয়ে যে সম্পদ উদ্ধৃত থাকবে শুধু মাত্র সেই সম্পদের উপরে যাকাত ফরজ হবে। বাদায়েউস সানায়ে ২/৩৯৪

নিজ প্রয়োজনীয় সম্পদের উদাহরণঃ-


১.নিজ ও পোষ্য পরিজনের অন্ন,বস্ত্র বাসস্থান ও বাহনের ওপর যাকাত ফরজ নয়। 
আদ্দুররুল মুখতার ২/২৬৫

২.গৃহের আসবাবপত্র।যেমনঃখাট,পালঙ্ক,চেয়ার-টেবিল,ফ্রিজ,আলমারি ইত্যাদি এবং গার্হস্থ সামগ্রী। যেমনঃ হাড়ি-পাতিল,থালা-বাটি,গ্লাস ইত্যাদির ওপর যাকাত ফরজ নয়। তা যত উচ্চ মূল্যেরই হোক না কেন। -মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক-হাদিসঃ৭০৯৩
তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে,সব বস্তুর উপর যাকাত আসে না সেগুলো যদি সোনা-রুপা সংযুক্ত থাকে তাহলে অন্যান্য যাকাত যোগ্য সম্পদের সাথে যুক্ত হয়ে যাকাত ফরজ হবে। 

৪.পরিধেয় বস্ত্র,জুতা যদি প্রয়োজনের তুলনা অনেক বেশিও থাকে তবুও তাতে যাকাত ফরজ হবে না। 
-রদ্দুল মুহতার ২/২৬৫

৫.দোকান-পাট,ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের এমন আসবাবপত্র যা ব্যবসা পণ্য নয়। তার ওপর যাকাত ফরজ হবে না। তবে ফার্নিচারের দোকানে বিক্রির উদ্দেশ্যে যেসব ফার্নিচার রাখা থাকে তা যেহেতু ব্যবসায়ী পণ্য তাই তার উপরে যাকাত ফরজ হবে।
 
৬.ঘরবাড়ি বা দোকান-পাট তৈরি করে ভাড়া দিলেও তাতে যাকাত ফরজ নয়। তবে এসব ক্ষেত্রে ভাড়া বাবদ যে অর্থ পাওয়া যাবে,তার ওপর যাকাত ফরজ হবে। 

৭.ভাড়া দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঘর-বাড়ি বা অন্য কোন সামগ্রী যেমন,ডেকোরেটরের বড় বড় ডেগ,থালা-বাটি ইত্যাদি  কিনলে,তার উপর যাকাত ফরজ হবে না। তবে ধারাবাহক প্রাপ্ত অর্থের ওপর যাকাত ফরজ হবে।  রদ্দুল মুহতার ২/২৬৫

নিসাবের মালিক হওয়াঃ  নিসাবের মালিক হওয়ার অর্থ তার কাছে এমন পরিমাণ সম্পদ থাকা শরীয়ত যা নিসাব হিসেবে নির্ধারণ করেছে।

নিসাবের বিবরণঃ 

স্বর্ণঃ স্বর্ণের ক্ষেত্রে যাকাতের নিসাব হল বিশ মিসকল। সুনানে আবু দাউদ ১/২২১ 
আধুনিক হিসেবে সাড়ে ৭ ভরি ( ৯৫.৭৪৮ গ্রাম প্রায়)
রুপাঃ রুপার ক্ষেত্রে নিসাব হলো দুইশত দিরহাম। সহীহ বুখারী ১৪৪৭, 
আধুনিক হিসেবে সাড়ে ৫২ তোলা (৬৭০.২৪ গ্রাম প্রায়)
আহসানুল ফতোয়া:৪/৩৯৪ আল ফিকহুল ইসলামী ২/৬৬৯

অন্যান্য জিনিসের ক্ষেত্রে যাকাতের নিসাবঃ

১.প্রয়োজনের উদ্বৃত্ত টাকা-পয়সা বা বাণিজ্য দ্রব্যের মূল্য যদি সাড়ে ৫২ তোলা রুপার সমপরিমাণ হয়, তাহলে যাকাতের নিসাব পূর্ণ হয়ে যাবে এবং তার উপরে যাকাত আবশ্যক হবে। মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক হাদিস ৬৭৯৭, ৬৮৫১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা হাদিস ৯৯৩৭। 

২.যদি সোনা-রূপা,টাকা-পয়সা কিংবা বাণিজ্য দ্রব্য এগুলোর কোনোটি পৃথকভাবে নিসাব পরিমাণ না থাকে।কিন্তু এসবের একাধিক সামগ্রী এ পরিমাণ হয়েছে যে,তা একত্রে সাড়ে ৫২ তোলা রুপার সমপরিমাণ মূল্য বা তার চেয়ে বেশি। তাহলেও যাকাতের নিসাব পূর্ণ হয়েছে বলে ধরা হবে এবং তার উপরে যাকাত আবশ্যক হবে। মোসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক হাদীস ৭০৬৬, ৭০৮১, মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৬/৩৯৩।

৩.কারো কাছে নিসাবের কম সোনা বা রুপা আছে। কিন্তু যে পরিমাণ সোনা আছে তার মূল্য মজুদ রুপার সাথে যোগ করলে সাড়ে ৫২ তোলা রুপার সমপরিমাণ হবে বা তার চেয়ে বেশি হবে। তাহলে সোনা-রুপার মূল্য হিসাব করে যাকাত আদায় করতে হবে।মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা হাদিস ৯৯৭৯ ১০৬৪৯, রদ্দুল মুহতার ২/৩০৩.

৪. কারো কাছে কিছু অলংকার আর কিছু উদ্বৃত্ত টাকা কিংবা বাণিজ্য দ্রব্য আছে যা একত্র করলে সাড়ে ৫২ তোলার সমপরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি হবে তাহলেও যাকাত আবশ্যক হবে। রদ্দুল মুহতার ২/৩০৩

বছর পূর্ণ হওয়াঃ যাকাত ফরজ হওয়ার আর একটা শর্ত হলো নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর পূর্ণ হওয়া। অর্থাৎ নিসাব পরিমাণ সম্পদের উপর পরিপূর্ণ একটি বছর অতিবাহিত হওয়া।

উদাহরণঃ

১.কারো কাছে সোনা-রুপা,টাকা-পয়সা কিংবা বাণিজ্য দ্রব্য পৃথকভাবে বা সম্মিলিতভাবে নিসাব পরিমাণ ছিল। বছরের মাঝে এ জাতীয় আরো কিছু সম্পদ কোন সূত্রে পাওয়া গেল। এক্ষেত্রে নতুন প্রাপ্ত সম্পদ পুরাতন সম্পদের সাথে যোগ হবে এবং পুরাতন সম্পদের বছর পূর্ণ হওয়ার পর সমুদয় সম্পদের যাকাত দিতে হবে। বছরের মাঝে যা যোগ হয়েছে তার জন্য পৃথক বছর পূর্ণ হওয়া আবশ্যক না। মুসান্নাফে ইবনে আব্দুর রাজ্জাক ৬৮৭২ 

২.বছরের শুরু ও শেষে নিসাব পূর্ণ থাকলে যাকাত আবশ্যক হবে। বছরের মাঝে নিসাব কমে যাওয়া ধর্তব্য নয়। অবশ্য বছরের মাঝে সম্পূর্ণ সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়।তবে ওই সময় থেকে নতুন করে বছরের হিসাব আরম্ভ করতে হবে এবং এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর যাকাত আদায় করতে হবে। মুসান্নাফে ইবনে আব্দুর রাজ্জাক ৭০৪২।

৩.যেদিন এক বছর পূর্ণ হবে সেদিনই যাকাত আদায় করা ফরজ হয়।এরপর যখনই যাকাত আদায় করুক সে পরিমাণে আদায় করতে হবে যা সেইদিন ফরজ হয়েছিল।

৪.বছর পূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে চন্দ্র মাসের হিসাব ধর্তব্য সৌর বর্ষের নয়।

৫.যে সম্পদের উপর যাকাত ফরজ হয়েছে,তার ৪০ ভাগের এক ভাগ (২.৫০%) যাকাত দেওয়া ফরজ। সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করে শতকরা আড়াই টাকা হারে নগদ টাকা কিংবা ওই পরিমাণ টাকার কাপড়-চোপড় বা অন্য কোন প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে দিলেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে।
 সুনানে নাসায়ী হাদিস ২২৩০।

কিভাবে যাকাত আদায় করবেঃ 

কোরআন মাজিদে আল্লাহ রব্বুল আলামীন তার অনুগত বান্দাদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে বলেনঃ-

 
وَالَّذِيْنَ يُؤْتُوْنَ مَا اتَوْا وَّقُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ اَنَّهُمْ إِلى رَبِّهِمْ رَاجِعُوْنَ ۝
-আর তারা যা কিছু দান করে এভাবে দান করে যে তাদের হৃদয় ভীতকম্পিত থাকে একথা ভেবে যে তারা তাদের রবের নিকটে ফিরে যাবে। সূরা মুমিনুন ৬০

অন্য আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুমিনদেরকে সতর্ক করে বলেনঃ- 

يَا اَيَّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا لَا تُبْطِلُوْا صَدَقتِكُمْ بِالْيَمِّ وَالْاَذى كَالَّذِيْ يُنْفِقُ مَالَه رِئَاءَ النَّاسِ وَلَا يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْاخِرِ. 

-হে ঈমানদারগণ তোমরা অনুগ্রহ ফলিয়ে ও কষ্ট দিয়ে তোমাদের দান-সদকা কে বিনষ্ট করো না,ঐ লোকের মত, যে লোক দেখানোর জন্য সম্পদ ব্যয় করে আর আল্লাহ ও আখেরাত দিবসের উপর ঈমান রাখে না। সূরা বাকারা ২৬৪।

কোরআন শরীফের উপরোক্ত আয়াত সমূহ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে,‌বিনয়, খোদাভীতি, ইখলাস ও আখলাকে হাসানা হল দান-সদকাহ আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার অভ্যন্তরীণ শর্ত। সুতরাং আমাদের সকলের কর্তব্য এসব বিষয়ে যত্নবান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সময় মত যা আদায় করে দেওয়া।

কাদেরকে যাকাত দিতে হবেঃ

কোরআন শরীফে যাকাতের খাত নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অন্য কোথাও যাকাত প্রদান করা জায়েজ নয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কোরআন মাজিদে বলেন 

إِنَّمَا الصَّدَقت لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسكِيْنِ وَالْعمِلِيْنَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوْبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغرِمِيْنَ وَفِي سَبِيْلِ اللهِ وَابْنِ السَّبِيْلِ ؕ فَرِيْضَةً مِّنَ اللهِ ؕ وَاللهُ عَلِيْمٌ حَكِيْمٌ.۝

যাকাত তো কেবল নিঃস্ব,অভাবগ্রস্থ ও যাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য,যাদের মনোরঞ্জন উদ্দেশ্য তাদের জন্য,দাস মুক্তির জন্য,ঋণগ্রস্থদের জন্য,আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফিরের জন্য। এ আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ,প্রজ্ঞাময়। সূরা তাওবা ৬০ 

ফকির বা অভাবগ্রস্তঃ- হানাফী মাজহাব মতে ফকির বলা হয় ওই ব্যক্তিকে যার মালিকানায় যাকাতের নিসাব পরিমাণ সম্পদ নেই। যদিও ওই ব্যক্তি কর্মক্ষম ও কর্মরত হয়। 

মিসকিন বা নিঃস্বঃ- মিসকিন বলা হয় ওই ব্যক্তিকে যার মালিকানায় কোন ধরনের সম্পদ নেই ।

লক্ষণীয় যে নিজের মা-বাবা,দাদা-দাদী,নানা-নানি,ছেলেমেয়ে,নাতি,নাতনি ফকির মিসকিন হলেও তাদের যাকাত দেওয়া যাবে না। পক্ষান্তরে নিজের ভাই-বোন,চাচা-চাচী,খালা-মামা,শশুর-শাশুরী,জামাতা নিঃস্ব ও অভাবগ্রস্থ হলে তাদের যাকাত দেওয়া যাবে।

যাদের অন্তর ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করা জরুরীঃ- যাদের অন্তর ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করা জরুরী তাদেরকে যাকাত দেওয়া বৈধ ছিল অর্থাৎ কাফেরদেরকে। তবে এই খাতটা মূলত ইসলাম যখন দুর্বল ছিল তখন ইসলামকে শক্তিশালী এবং ইসলামের দিকে মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। আর এখন যেহেতু ইসলাম পরিপূর্ণ শক্তিশালী তাই আর এই খাতে যাকাত দেওয়া যাবে না। সুতরাং কেউ যদি কোন অমুসলিমকে যাকাত দেয় তাহলে তার যাকাত পুনরায় আদায় করতে হবে। ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া ১/১৮৮, ফতোয়ায়ে তাতারখানিয়া ৩/২১১, রদ্দুল মুহতার ২/৩৫১

আমেল তথা যাকাতের অর্থ সংগ্রহকারীঃ- ইসলামী সরকারের পক্ষ থেকে যাকাত সংগ্রহে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের আমেল বলা হয়। তাদের সংগৃহীত যাকাতের সম্পদ থেকে বিনিময় দেওয়া বৈধ। তবে বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক যাকাত সংগ্রহে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কমিশন হারে যাকাত থেকে বিনিময় দোয়া কোনভাবেই শরীয়তসম্মত নয়।

গোলাম-দাস মুক্তির জন্যঃ- বর্তমানে গোলাম বা দাসের প্রথা পৃথিবীতে নাই, বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সুতরাং এই খাত না থাকায় যাকাতও নাই।

ঋণ মুক্তির জন্যঃ- কোন ব্যক্তি এই পরিমাণ ঋণগ্রস্ত হলে তাকে যাকাত দেওয়া যাবে যার ঋণ আদায় করার পর তার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ অবশিষ্ট থাকে না। 

আল্লাহর রাস্তায় থাকা ব্যক্তিঃ- যেসব মুসলমান আল্লাহর পথে রয়েছে তাদের কাছে প্রয়োজনীয় অর্থ সম্পদ না থাকলে তাদের যাকাত দেওয়া যাবে। বেশিরভাগ ওলামায়ে কেরাম ও ইমামের মতে আল্লাহর রাস্তা বলতে এখানে আল্লাহর পথে জিহাদকারী ব্যক্তিদের বোঝানো হয়েছে। 

মুসাফিরঃ কোন ব্যক্তি যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও কোথাও সফরে এসে সম্পদ শূন্য হয়ে পড়ে তাহলে তাকে বাড়িতে পৌঁছার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ যাকাত হিসেবে দেওয়া যাবে।

যাকাতের খাতের আরো কিছু উদাহরণঃ-

১.যে দারিদ্র ব্যক্তির কাছে অতি সামান্য মাল আছে অথবা কিছুই নেই এমনকি একদিনের খোরাকীও নেই এমন লোক শরীয়তের দৃষ্টিতে গরিব তাকে যাকাত দেওয়া যাবে।

২.যে ব্যাক্তির কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদ অর্থাৎ সোন-রূপা,টাকা-পয়সা,বাণিজ্যদব্য ইত্যাদির নিসার পরিমাণ আছে সে শরীয়তের দৃষ্টিতে ধনী তাকে যাকাত দেওয়া যাবে না। 

৩.অনুরূপভাবে যে ব্যক্তির কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদ নিসাব পরিমাণ নেই। কিন্তু অন্য ধরনের সম্পদ আছে যাতে যাকাত আসে না।যেমন,ঘরের আসবাবপত্র,পরিধেয় বস্ত্র,জুতা,ঘরের ব্যবহারিক পণ্য সামগ্রী ইত্যাদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত এবং নিসাব পরিমাণ আছে তাকে যাকাত দেওয়া যাবে না। মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক হাদিস ৭১৫৬ । এই ব্যক্তির উপর সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব।

৪.যে ব্যক্তির কাছে যাকাতযোগ্য সম্পদ নিসাব পরিমাণ নেই এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত অন্য ধরনের মাল-সামানাও নেশা পরিমাণ নেই এই ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া যাবে। 

৫.যে ব্যক্তি এমন ঋণগ্রস্ত যে,ঋণ পরিশোধ করার পর তার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে না তাকে যাকাত দেওয়া যাবে। 

৬.কোন ব্যক্তি নিজ বাড়িতে নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী। কিন্তু সফরে এসে অভাবে পড়ে গেছে বা মাল-সামানা চুরি হয়ে গেছে। এমন ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া যাবে তবে এ ব্যক্তির জন্য শুধু প্রয়োজন পরিমাণ গ্রহণ করা জায়েজ, এর বেশি নয়। 

৭.যাকাতের টাকা এমন দরিদ্র লোককে দেওয়া উত্তম যে দ্বীনদার। দ্বীনদার নয় এমন লোক যদি যাকাতের উপযুক্ত হয় তাহলে তাকেও যাকাত দেয়া যাবে তবে যদি প্রবল ধারণা হয় যে যাকাতের টাকা দেয়া হলে লোকটি সে টাকা গুনাহের কাজে ব্যয় করবে। তাহলে তাকে যাকাত দেওয়া জায়েজ নেই। 

৮.যাকাত শুধু মুসলমানকেই দেওয়া যাবে। হিন্দু,বৌদ্ধ,খ্রিস্টান বা অন্য কোন অমুসলিমকে যাকাত দেওয়া হলে যাকাত আদায় হবে না। পুনরায় আদায় করতে হবে। তবে নফল দান-খয়রাত অমুসলিমকেও করা যায়। 

৯.আত্মীয়-স্বজন যদি যাকাত গ্রহণে উপযুক্ত হয় তাহলে তাদেরকে যাকাত দেওয়ায় উত্তম। ভাই-বোন, ভাতিজা,ভাগ্নে,চাচা,মামা,ফুফু,খালা এবং অন্যান্য আত্মীয়দের কে যাকাত দেওয়া যাবে। 

১০.কোন লোককে যাকাতের উপযুক্ত মনে হওয়ায় তাকে যাকাত দেয়া হলো। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল লোকটির নিসাব পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তাহলে ও যাকাত আদায় হয়ে যাবে। পুনরায় যাকাত দিতে হবে না। তবে যাকে যাকাত দেওয়া হয়েছে সে যদি জানতে পারে যে,এটা যাকাতের টাকা ছিল সেক্ষেত্রে তার ওপর তা ফেরত দেওয়া ওয়াজিব।

১১. অপ্রাপ্তবয়স্ক (বুঝবান) ছেলে মেয়েকে যাকাত দেওয়া যায়। রদ্দুল মুহতার ২/২৫৭

মোট কথা যাকাতের টাকা এর হকদার কেই দিতে হবে অন্য কোন ভাল খেতে ব্যয় করলেও যাকাত আদায় হবে না। 

যাকাত কাদেরকে দেওয়া যাবে নাঃ 

১.নিজ পিতা-মাতা,দাদা-দাদি,নানা-নানি,পরদাদা ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গ যারা তার জন্মের উৎস তাদেরকে যাকাত দেওয়া জায়েজ নয়। এমনি ভাবে নিজের ছেলে-মেয়ে,নাতি-নাতিন এবং তাদের অধস্তনকে সম্পদের যাকাত দেওয়া জায়েজ নয়। স্বামী এবং স্ত্রী একে অপরকে যাকাত দেওয়া জায়েজ নয়। রদ্দুল মুহতার ২/২৫৮

২. যাকাতের টাকা যাকাতের হকদার নিকট পৌঁছে দিতে হবে যাকাতে নির্ধারিত খাতে ব্যয় না করে অন্য কোন জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হলে যাকাত আদায় হবে না। যেমন রাস্তাঘাট ফুল নির্মাণ করা খুব খনন করা বিদ্যুৎ পানি ইত্যাদির ব্যবস্থা করা। 

৩.যাকাতের টাকা মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ,ইসলাম প্রচার ইমাম মুয়াজ্জিনের বেতন ভাতা,ওয়াজ মাহফিল করা,দ্বীনি বই-পুস্তক ছাপানো,ইসলামী মিডিয়া তথা রেডিও টিভির চ্যানেল করা ইত্যাদির ক্ষেত্রেও ব্যয় করা জায়েজ নেই। 

৪.বাড়ির কাজের ছেলে বা কাজের মেয়েকে যাকাত দেওয়া যায় যদি তারা যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হয়। তবে কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে যাকাতের অর্থ দিলে যাকাত আদায় হবে না। কেউ কেউ কাজের লোক রাখার সময় বলে মাসে এত টাকা করে পাবে আর ঈদে একটা বড় অংক পাবে এক্ষেত্রে ঈদের সময় দেওয়া টাকা যাকাত হিসেবে প্রদান করা যাবে না। সেটা তার পারিশ্রমিকের অংশ বলেই ধর্তব্য হবে।সুতরাং দিলে জায়েজ হবে না। 

৫.যাকাত দেওয়ার পর যদি জানা যায় যে যাকাত গ্রহীতা অমুসলিম ছিল,তাহলেও যাকাত আদায় হবে না। পুনরায় যাকাত আদায় করতে হবে।

যাকাত আদায় হওয়ার শর্ত ঃ- 

যাকাত আদায় হওয়ার শর্ত হল উপযুক্ত ব্যক্তিকে মালিক বানিয়ে দেওয়া।যাতে সে নিজের ইচ্ছা খুশি মত তার প্রয়োজন পূরণ করতে পারে।এমন না করে যদি যাকাতদাতা নিজের খুশিমত দারিদ্র লোকটির কোন প্রয়োজনে টাকা ব্যয় করে যেমনঃ তার ঘর সংস্কার করে দিল,টইলেট স্থাপন করে দিল তাহলে যাকাত আদায় হবে না।রদ্দুল মুহতারঃ ২/২৫৭।

নিয়ম হল যাকাতের টাকা দারিদ্রকে ব্যক্তিকে দিয়ে মালিক বানিয়ে দিবে আর দারিদ্র ব্যক্তি নিজের ইচ্ছা মত তা খরচ করবে।

والله اعلم بالصواب

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

সত্যের কাফেলার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন।প্রতিটি কমেন্ট রিভিও করা হয়। ;

comment url